মাহিদুল মাহিদ, সাভার
সাভারের বহুল আলোচিত অখ্যাত গ্রুপ কোম্পানি ‘হল মার্কের’ ভরারী এলাকার জমি সিনেমা স্টাইলে জাল দলিলের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়েছিল। তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে জমির মালিক সাজিয়ে জাল স্বাক্ষর ও টিপসই নিয়ে দলিল তৈরি করে দখল করেছিল চক্রটি। প্রায় ১৭ বছর পর ৯২ শতাংশ জমি খারিজ পেয়েছেন জমির মূল মালিক নিলুফা হক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে মতিয়ার রহমান ও তারু মিয়ার কাছ থেকে ২৪৯ শতাংশ জমি ক্রয় করেন নিলুফা হক নামে এক নারী। ২০০৫ সালে তিনি শামসুদ্দিন ও মাহবুবুর রহমানের কাছে বায়নানামা দলিল করে দেন।
পরবর্তীতে মতিয়ার রহমান ও শামসুদ্দিন আর নিলুফা হকের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রেশন করে না নিয়ে সময় ক্ষেপণ করেন। তারা রেজিস্ট্রেশন করে না নেওয়ায় খোঁজ নিয়ে নিলুফা জানতে পারেন তার জমি জাল স্বাক্ষর ও টিপসই দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে।
বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত তিনি আদালতে সিআর মামলা করেন। এরইমধ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে শামসুজ্জামান ও মাহবুবুর রহমান ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে পরপর জমিটি কমপক্ষে ৪টি দলিল করেন। সর্বশেষ দলিল করেন হলমার্ক গ্রুপের নামে। এখানে ব্যবহার করা হয় আরও ছয় জনের নাম। যাদের শুধু নামের সাদৃশ্যই রয়েছে, বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জমির প্রকৃত মালিক নিলুফা হকের সিআর মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয় সাভার মডেল থানায়। এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০১৯ সালে মামলার তদন্ত শুরু করেন সাভার মডেল থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক এসআই অপুর্ব দাশ। ২০২০ সালে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন তিনি।
এসআই অপূর্ব দাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই জমিটির ব্যাপারে একটি কোর্ট পিটিশন মামলা করেন ভুক্তভোগী। আমি ২০১৯ সালে মামলাটির তদন্তভার পেয়ে তদন্ত কাজ শুরু করি। মামলার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল একটি জমি বিক্রেতা আসলেই ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেছিলেন কি না। স্বাক্ষর এবং টিপসই বাদী ও বিক্রেতা নিলুফা হকের কি না। সিআর মামলা নম্বর যতদূর মনে পড়ে ১১/৬৫।
জমিটি বর্তমানে হল মার্কের নামে রয়েছে। জমিটি মুলত সাভারের সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল। তবে নিলুফার হক দাবি করেন দলিলে জাল স্বাক্ষর ও জাল টিপসই দেওয়া। যা তার স্বাক্ষর ও টিপসই নয়। কোনো এক নারীকে নিলুফা সাজিয়ে তারই স্বাক্ষর ও টিপসই ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীতে কোর্টের অর্ডার নিয়ে দলিল জব্দ করে মামলার বাদীসহ কোর্টে গেলাম। সেখানে বিচারক সিআইডি থেকে ডেট ফিক্সড করে অফিসার তলব করল।
তারিখ অনুযায়ী সিআইডি এসে বিচারকের সামনেই ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ৫ থেকে ৭টি কাগজে স্বাক্ষর নিলেন। পরে খামবুকের স্বাক্ষর ও টিপসইয়ের সঙ্গে মিলানোর চেষ্টা করলেন। খামবুকে লেখা ছিল নিলুফার। এমনিতেই বোঝা যাচ্ছিল নিলুফার স্বাক্ষরের সাথে খাম বুকের স্বাক্ষরের কোনো মিল নেই। তারপরও সিআইডি পরিক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রেজাল্ট দিল যে নিলুফার ফিঙ্গার প্রিন্ট ও দলিলের স্বাক্ষরের সঙ্গে কোনো মিল নেই।
তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও বলেন, পরে আদালতে প্রমাণ হলো নিলুফা এই জমি আসলেই বিক্রি করেন নাই। যে কোনো এক নারীকে নিলুফা সাজিয়ে ২০০৫ সালে এই জমিটি দলিল করে নেন একটি পরিপক্ব চক্র। পরবর্তীতে ওই দলিল দেখিয়ে জমিটি কয়েকবার কেনা-বেচা হয়েছে। কিন্তু নিলুফার প্রকৃত জমির মালিক। যেহেতু তিনি জমিই বিক্রি করেন নাই সেহেতু তাদের দলিলটি ভুয়া।
পরবর্তীতে সিআর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিলাম ২০২০ সালে। আদালত এত বড় জালিয়াতি দেখে পুরো চক্রের বিরুদ্ধে এফআইআর করার নির্দেশ দেন। পরে সাভার মডেল থানায় দলিলে উল্লেখিত নামের বিরুদ্ধে কোর্টের নির্দেশে মামলা দায়ের হয়। ওই মামলার দায়িত্বও আমাকেই দেওয়া হয়। আমি দলিলে উল্লেখিত প্রত্যেক ঠিকানায় গেলাম, কিন্তু তাদের কোনো সন্ধানই পেলাম না। দলিলে যেসব নাম ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে তা ভুয়া। তাদের আইডিকার্ডও ছিল ভুয়া।
পরবর্তীতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দিলাম। আসামিদের যেহেতু কোনো বাস্তব ঠিকানা নেই, সেহেতু পরবর্তীতে তাদের খুঁজে পাওয়া গেলে মামলা আবার শুরু করা যাবে। এরা যে কতবড় জালিয়াতি চক্র তা বোঝাই যায়। তারা সরকারের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করেছে, জায়গাও জালিয়াতির মাধ্যমে ক্রয় করেছে।
এ ব্যাপারে নিলুফার হক বলেন, আমি ২০২১ সালে সেই জমির ৯২ শতাংশ জমি খারিজ পেয়েছি। খারিজ পেয়ে এ বছরেই আমি আবারও বায়না দলিল করে দিয়েছি শাহাদাত হোসেনের কাছে। তিনি বর্তমানে বায়না সূত্রে মালিক। ওই ৯২ শতাংশ জমি দীর্ঘদিন পরে ফিরে পেয়েছি। আর তারা যে শ্রেণির প্রতারক তা শয়তানকেও হার মানায়।
শাহাদাত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০২২ সালে ওই ৯২ শতাংশ জমি মুল মালিক নিলুফা হকের কাছ থেকে বৈধভাবে কিনেছি। আমি জেনে-বুঝে সজ্ঞানে এই জমি কিনেছি। কারণ এর বৈধ মালিক নিলুফা হকই। তবে এ ব্যাপারে বক্তব্য চাইলে দায়িত্বে থাকা হলমার্কের কোনো কর্মকর্তা মুখ খোলেননি।
এ ব্যাপারে হলমার্কের ম্যানেজার (মানবসম্পদ) আব্দুর রশিদ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কোম্পানি ২০১১ সালে জায়গাটি ক্রয় করেছিল। কাগজপত্রে দেখা জায় পুরো জায়গাটাই আমাদের দলিল করা জায়গা। মালিকানা জায়গা থেকে আমরা জমিটা কিনেছি। কয়েকদিন আগে শাহাদাত সাইনবোর্ড টানিয়েছে। এ ছাড়া নিলুফা নামে আরও একটি সাইনবোর্ড সেখানে আছে।
আমার কথা হলো, আমরা জমি কিনেছি ১১ সালে। এত বছর আগে আমরা জমিটি কিনেছি, অথচ জমির কোনো মালিক দেখিনি। জমি কেউ এসে দাবিও করেনি। আমরা ঘর উঠিয়েছিলাম, সেটাও ভেঙে নিয়ে গেছে। আমরা শামসুদ্দোহার কাছ থেকে জমি কিনেছিলাম। তবে ওই ৯২ শতাংশ জায়গার কোনো খারিজ আমরা করিনি। এই কাগজ আমাদের নেই।